বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) দুই হাজার ডলার অতিক্রম করতে যাচ্ছে। সরকারের অর্থবিভাগের পক্ষ থেকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির এই হিসাব প্রাক্কলনের খবর জানা যায়। চলতি অর্থবছরে, ২০১৯-২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলার অতিক্রম করবে বলে হিসাব করেছেন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির অনেকগুলো সূচক রয়েছে। একটি দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে সূচকগুলো পরিমাপ করা হয়। সাধারণত একটি দেশের আয় উৎপাদন যখন বাড়ে তখন অর্থনৈতিক সূচক হয় ঊর্ধ্বগামী। এ ধরনের পরিবর্তন দেশের জনগণের সামগ্রিক জীবনমানের পরিবর্তনে যদি ভূমিকা রাখে তাহলে তাকে ‘সফল উন্নতি’ বলা যায়। আমরা দেখেছি, বিগত এক দশকে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে। একই সময় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দ্বিগুণ বেড়েছে, এমন পরিসংখ্যান কিন্তু জানা যায় না।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির রেকর্ড ঊর্ধ্বমুখী। ২০১০-১১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৯২৮ ডলার। এরপর ধারাবাহিকভাবে এর বেড়ে চলা অব্যাহত রয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৯৫৫ ডলার, ২০১২-১৩ তে এক হাজার ৫৪ ডলার, ২০১৩-১৪ তে এক হাজার ১৮৪ ডলার, ২০১৪-১৫ তে এক হাজার ৩১৬ ডলার, ২০১৫-১৬ তে এক হাজার ৪৬৫ ডলার, ২০১৬-১৭ তে এক হাজার ৬১০ ডলার, ২০১৭-১৮ তে এক হাজার ৭৫১ ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৯০৯ ডলারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০৭৯ ডলার হচ্ছে। একই সময়ে মানুষের জীবনে মাথাপিছু এই আয় বৃদ্ধি কী সফলতা বয়ে এনেছে, তার সঠিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে এটা অন্তত বলা যাচ্ছে, ঠিক যে সময়টায় বাংলাদেশের মানুষের আয় দ্বিগুণ হয়েছে বলে হিসাব করা হয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে যায়নি। এখনো এ দেশে চার কোটি মানুষ দরিদ্র। করোনার আঘাতের পর ইতোমধ্যে আরো ৫০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ এই দরিদ্রদের সাথে যোগ হয়েছে। সরকার দরিদ্রদের সহায়তার জন্য নানা ধরনের ত্রাণ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এগুলো যদি সঠিকভাবে বণ্টন করা না হয় তাহলে তাদের দারিদ্র্য আরো বাড়বে।
‘মাথাপিছু আয়’ মানে, প্রত্যেক মানুষের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া নয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাব আসে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হিসাব থেকে। বাংলাদেশে কিছু মানুষের আয় অনেক বেড়ে গেছে। ধনী মানুষ বৃদ্ধির সংখ্যায় বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। উদ্বৃত্ত আয় যদি কেবল কিছু মানুষের লাভকে বৃদ্ধি করে তা প্রকৃতপক্ষে জাতির কী উপকারে আসতে পারে? প্রত্যেক মানুষ কমবেশি একই পরিমাণ খায়। কিন্তু কিছু মানুষের জন্য শুধু দৈনিক আহারের ব্যবস্থাই থাকে না। তাহলে মুষ্টিমেয় মানুষের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে ‘জাতীয় আয়ের ঊর্ধ্বমুখী’ হিসাব দেখানোর মাধ্যমে আত্মপ্রশস্তি অর্জন করা যেতে পারে; কিন্তু তা মানুষের উপকারে আসে না বাস্তবে। বিগত ১০ বছরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কতটুকু বেড়েছে তার একটা হিসাব করা হলেই মূলত দ্বিগুণ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কার্যকারিতা আমরা অনুমান করতে পারতাম। তবে জনমানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপন থেকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ৫৫ শতাংশ মানুষ নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এরা মূলত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, যারা দৈনিক এক ডলার ৯০ সেন্ট থেকে তিন ডলার ৮০ সেন্ট আয় করে থাকেন। করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দায় এরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হতে পারেন। আর আগে থেকে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারীরা তো এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেনই। জাতীয় আয় বৃদ্ধির রেকর্ডকে সত্যিকার অর্থে জাতির কল্যাণে রূপান্তর করতে হলে দেশের মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সুযোগ গ্রহণের পথ করে দিতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এমন গণমুখী অবস্থান গ্রহণের পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।
Leave a Reply